২০১১ সালে মিশরের কায়রো শহরে তাহরির স্কয়ারে জনতা নেমে এসেছিল মিশরের স্ট্রং ম্যান হোসনি মোবারকের পদত্যাগের দাবিতে। পৃথিবীর ইতিহাসে গণতন্ত্রের দাবিতে বা কোনো একনায়কতন্ত্রের বা স্বৈরতন্ত্রের পদত্যাগের দাবিতে জনতা নেমে আসা নতুন কোনো ঘটনা নয়। রোমান সাম্রাজ্যের আমলেও জনতা রাজপথে নেমেছে। তেমনি গত শতাব্দীর শেষভাগে চায়নার তিয়েনআনমেন স্কয়ার থেকে বর্তমানে রাশিয়ায় নাভালিনের স্বপক্ষে জনতা রাজপথে নামছে। কিন্তু এ সবের ভেতর তাহরির স্কয়ার কেন ইতিহাসে একটু আলাদা। সেখানে জনতা ও দাবির কোনো নতুনত্ব ছিল না। ছিল পদ্ধতির সঙ্গে নতুন প্রযুক্তির সংযোগ। অর্থাৎ ওই প্রথম তথ্যপ্রযুক্তির মাধ্যমে জনতাকে ডাক দিয়ে সাধারণ জনতা স্বতঃস্ফূর্তভাবে কোনো নেতৃত্ব ছাড়া একনায়কের পদত্যাগের দাবিতে রাজপথে আসে। বর্তমানে রাশিয়ায় নাভালিন যে আন্দোলন করছেন, সেখানেও তথ্যপ্রযুক্তি মূল ভূমিকা পালন করছে। কিন্তু পার্থক্য হলো, এখানে নাভালিন নেতা, তথ্যপ্রযুক্তির মাধ্যমে গড়ে ওঠা তার সমর্থকেরা রাজপথে আসছে।
তাহরির স্কয়ারের আগে তিয়েনআনমেনে চায়নায় যে গণঅভ্যুত্থান ঘটেছিল, সেখানেও প্রথমে ওইভাবে সুস্পষ্ট কোনো নেতা ছিল না। তারপরেও তাকে মিশরের এই জনতা নেমে আসার সঙ্গে শতভাগ মেলানো যায় না এ কারণে যে, সেখানে ছাত্রদের একটি সুসংগঠিত নেতৃত্ব ছিল। হয়তো কোনো বিশেষ নেতা ঠিক করা ছিল না। তাই সব মিলিয়ে তাহরির স্কয়ারের এই জনতা নেমে আসার ঘটনা পৃথিবীর ইতিহাসে নতুন, এবং তথ্যপ্রযুক্তির এই নতুন যুগে প্রথম রাজনৈতিক আন্দোলনে তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহার।
ওই আন্দোলনে বাস্তবে জনতা বিজয়ী হয়েছিল কিনা, তা এখন নতুন করে কিছুটা প্রশ্নের সৃষ্টি করছে। কারণ আমেরিকার সাবেক প্রেসিডেন্ট বারকা ওবামা তার সাম্প্রতিক স্মৃতিচারণে লিখেছেন, তিনি মিশরের স্ট্রংম্যান হোসনি মোবারককে ফোন করে প্রেসিডেন্টের পদ থেকে পদত্যাগ করতে বলেন। ওবামা আরও স্বীকার করছেন, তার ওই ফোন কলের পরে শুধু হোসনি মোবারকই পদত্যাগ করেনি, আরব বিশ্বে দ্রুত এই আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে। বাস্তবে এই আন্দোলন ছড়িয়ে পড়েছিল বাহরাইন, সিরিয়া, লিবিয়া, তিউনিশিয়া ও অনান্য দেশে।
মিশর থেকে মুসলিম বিশ্বের যে দেশগুলোতে এই আন্দোলন ছড়িয়ে পড়েছিল এর মধ্যে সিরিয়ার সরকারপ্রধান ছাড়া আর কেউই ক্ষমতায় থাকতে পারেন নি। তবে সিরিয়ার বাশারকে ক্ষমতায় থাকার জন্যে মূল্য দিতে হয়েছে অনেক। তার গোটা শহর, গোটা দেশ ধ্বংসস্তুপ। সেখানে বিভিন্ন গ্রুপ বিভিন্ন এলাকা নিয়ন্ত্রণ করে। তাছাড়া দুই পক্ষে ভাগ হয়ে রাশিয়া ও আমেরিকা সেখানে সরাসরি হস্তক্ষেপ করে, যদিও ট্রাম্প আমেরিকার অনেক সৈন্য ফিরিয়ে নিয়ে গেছেন।
অন্যদিকে, সব থেকে বড় বিষয় হলো হোসনি মোবারক থেকে গাদ্দাফি কারো পদত্যাগের পরেই কিন্তু সেখানে কোনো গণতান্ত্রিক সরকার আসেনি। এবং মুসলিম বিশ্বের এই দেশগুলোতে এখন গণতন্ত্র অনেক দূরে অবস্থান করছে। তার কোনো ক্ষীণ রেখাও দেখা যাচ্ছে না। বরং সেখানে যা ঘটেছে, তা হলো আমেরিকার এক ধরনের সরকারের বদলে সেখানে আমেরিকার পছন্দের আরেক ধরনের সরকার বসেছে, আর যারা আমেরিকার পছন্দের নয়, তারা নিহত হয়েছেন।
তবে তারপরও কায়রোর তাহরির স্কয়ারের বিপ্লব পৃথিবীতে ‘আরব স্প্রিং’ অর্থাৎ ‘আরব বসন্ত’ নামে পরিচিত। মিডল ইস্ট বিষয়ক রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা এবং ওই আন্দোলনের অ্যাক্টিভিস্টরা এখনও মনে করেন তাহরির স্কয়ার থেকে যা শুরু হয়েছিল, সেটা আরব বসন্তই । আর এ কোনো মতেই শেষ হয়নি।
যদিও সাধারণ মানুষ মনে করে ভবিষ্যতের কোনো মানুষ জানবে না যে, গণতন্ত্রের জন্যে আরব বিশ্বে এই আন্দোলন হয়েছিল। এগুলো খুব স্বাভাবিকই মানুষের স্মৃতির অতলে চলে যাবে। কিন্তু ইয়েমেনের আন্দোলনের একজন তাওয়াক্কুল কারমান, যিনি ২০১১ সালে নোবেল পেয়েছেন, তার মতে ‘আমাদের জনগণের স্বপ্ন মারা যায়নি এবং মারা যাবে না।’
তেমনি তাহরির স্কয়ারের এক আন্দোলনকারী তারেক আল মিনশওয়ের বক্তব্য আরও স্পষ্ট, তিনি বলেন নতুন জেনারেশন দেখেছে কী ঘটেছে। তাই এটা ধ্বংস হবে না। কারণ, স্বাধীনতা বা গণতন্ত্রের স্বাদ মূলত হাঙ্গরের রক্তের স্বাদ পাবার মতো। এ যদি একবার মানুষ পায়, তাহলে সে বার বার সেখানে ফিরে আসে। আরব বিশ্ব বা মুসলিম বিশ্বের নতুন প্রজম্ম হয়তো যতদিন গণতন্ত্র না পাবে, ততদিন বার বার গণতন্ত্রের জন্যে ফিরে আসবে। যে কারণে হয়তো সৌদি আরব ইতোমধ্যে অনেক ক্ষেত্রে উদারনীতি নিতে বাধ্য হচ্ছে।
আরব বিশ্ব বা মুসলিম বিশ্বের সঙ্গে মুসলিম অধ্যুষিত বাংলাদেশকে মেলানোর কোনো সুযোগ নেই। কারণ বাংলাদেশ মুসলিম অধ্যুষিত, এখনও সংবিধানে ধর্মনিরপেক্ষতার পাশাপাশি রাষ্ট্র ধর্ম ইসলাম। তারপরেও বাংলাদেশ কোনো মতেই মুসলিম দেশ নয়। আর বাংলাদেশের মানুষের রক্তে রয়ে গেছে হাঙ্গরের রক্তের স্বাদের মতো গণতন্ত্রের স্বাদ। তাই দেখা যায়, ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে বাংলাদেশের ছেলেরা সব সময়ই এগিয়ে ছিল। তাই ভারতবর্ষের স্বাধীনতা আন্দোলনে সব থেকে বেশি প্রাণ দিয়েছে বাঙালি ছেলেরা।
এখানে পাকিস্তান সৃষ্টির পরে বাঙালি মুসলিম প্রগ্রেসিভ তরুণদের মনে একটি অপরাধ বোধ জেগেছিল, যা কমরুদ্দিন আহমদসহ অনেকের লেখাতে এবং তাজউদ্দিন আহমদের ডায়েরিতে পাওয়া যায়। সর্বোপরি পাওয়া যায় বঙ্গবন্ধুর বিভিন্ন ভাষণে। এই যেমন ভাষা আন্দোলন প্রসঙ্গে ১৯৭১ সালের ২১ ফ্রেব্রুয়ারি দেয়া ভাষণে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, যখন পাকিস্তান পার্লামেন্টে প্রথম বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত কথা বলেন, তখন আমাদের মুসলমান পার্লামেন্ট সদস্যরা কোথায় ছিলেন?
তবে ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের বাঙালি মুসলিম তরুণরা যা পারেনি, পাকিস্তান সৃষ্টির পরে তারাই অচিরে গণতন্ত্র ও স্বাধীনতার জন্যে জীবন দানের সারিতে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে দাঁড়িয়ে যায়। আর ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে যতো জীবনদান ঘটেছে, তার থেকে শতগুণ বেশি জীবন দিয়ে বাঙালি মুসলমানেরা এ উপমহাদেশে শহীদের সংখ্যার শীর্ষে নিজেদের নিয়ে গেছে। কিন্তু তারপরেও বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও গণতন্ত্র বার বার ব্যহত হয়েছে।
স্বাধীনতার মাত্র সাড়ে তিন বছরের মধ্যে স্বাধীনতার নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে হত্যা করার ভেতর দিয়ে এ দেশের গণতন্ত্রকে সম্পূর্ণরূপে ও স্বাধীনতাকে অনেকাংশে নস্যাৎ করা হয়। কিন্তু ওই যে কায়রোর গাড়ি পালিশকারী বলেছেন, স্বাধীনতার ও গণতন্ত্রের স্বাদ হাঙ্গরের রক্তের স্বাদ পাবার মতো, একবার এ স্বাদ পেলে তার থেকে ফেরানো যায় না। যে কারণে ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করে গণতন্ত্র হত্যা করা হলেও বাংলাদেশে গণতন্ত্রের আন্দোলন ও জনগণের অধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলন থেকে মানুষকে ফেরানো যায়নি। শেষাবধি শেখ হাসিনার নেতৃত্বে এ দেশের মানুষকে তিনবার গণতন্ত্রের আন্দোলনে বিজয়ী হতে হয়েছে। আর এখানেও প্রমাণিত হয়, গণতন্ত্রের স্বাদ থেকে মানুষকে ফেরানো যায় না। তাই ১৯৯০ সালে গণতন্ত্রের আন্দোলনে বিজয়ী হবার পরে বিএনপি ১৯৯৬ সালে গণতন্ত্র ধ্বংস করলে ১৯৯৬-এ শেখ হাসিনার নেতৃত্বে গণতন্ত্রের আন্দোলনে আবার বিজয়ী হয় মানুষ। এই দ্বিতীয় বার গণতন্ত্রের আন্দোলনের বিজয়ী হলেও আবারও ২০০১ এবং সর্বোপরি ১/১১ আসে। আবারও ২০০৮-এ শেখ হাসিনার নেতৃত্বে গণতন্ত্রে বিজয়ী হয় বাংলাদেশের মানুষ।
গণতন্ত্রের আন্দোলনে বার বার বিজয়ী হলেও বাংলাদেশে ১৯৭১ সালে যে মূল্যবোধ নিয়ে স্বাধীনতা অর্জিত হয়েছিল, ১৯৭৫ সালে যে মূল্যবোধ বঙ্গবন্ধুকে হত্যার ভেতর দিয়ে হত্যা করা হয়, তার শতভাগ এখনও ফেরত আসেনি। আর যেহেতু স্বাধীনতার স্বাদও ওই কায়রোর গাড়ি পালিশওয়ালার কথামতো হাঙ্গরের রক্তের স্বাদের মতো, তাই কায়রোর তাহরির স্কয়ারের মতোই বাংলাদেশে শাহবাগে এসেছিল শাহবাগ বসন্ত। সেখান থেকে গোটা বাংলাদেশে ছড়িয়ে গিয়েছিল ১৯৭১ সালের স্বাধীনতার রণধ্বনি ‘জয় বাংলা’। আর ওই শাহবাগ বসন্তই ভূমিকা রেখেছিল ১৯৭১-এর স্বাধীনতাবিরোধী নেতাদের অর্থাৎ যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসি দিতে।
বারাক ওবামা তার স্মৃতিচারণে লিখেছেন, তিনি ফোন করেছিলেন হোসনি মোবারককে পদত্যাগ করতে। হোসনি মোবারক তার কথা মতো পদত্যাগ করেন। আরব বসন্ত বিজয়ী হয়। অন্যদিকে হয়তো কোনোদিন জন কেরি তার স্মৃতিচারণে লিখবেন, তিনি বাংলাদেশের যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসি না দেবার জন্যে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ফোন করেছিলেন। শেখ হাসিনা উত্তর দিয়েছিলেন, তার দেশে আইন নিজস্ব গতিতে চলবে। যার ফলে সেদিন শাহবাগ বসন্ত সফল হয়েছিল। কিন্তু তারপরেও আরব বসন্তের মতো শাহবাগ বসন্তও শেষাবধি ব্যর্থ হয়েছে। বাংলাদেশে এখন দিকে দিকে মৌলবাদীরা। কিন্তু ভবিষ্যত কোনো মতেই মৌলবাদীদের জন্যে নয়, ভবিষ্যত শাহবাগে যারা ‘জয় বাংলা’ ধ্বনি তুলেছিল, তাদের জন্য। কারণ, স্বাধীনতার স্বাদ শাহবাগ প্রজম্ম তরুণ প্রজম্মের মধ্যে পৌঁছে দিয়েছে। একে রুখে দিতে পারবে না কেউ। সৎ এবং সত্য আকাঙ্খার কখনও মৃত্যু হয় না। শেষ বিজয় তার কপালেই লেখা থাকে।